Friday, June 7, 2019

এই,এই...প্লীজ উঠোনা লক্ষিটি...এই উঠো

SHARE

এতক্ষণ তুর্য দেখছিল ওর বস ওর দিকে এতগুলা ফাইল ছুঁড়ে মেরেছেন। কিন্তু তার পর পরই বস হঠাৎ মেয়েদের আওয়াজে কথা বলছেন দেখে পেট ফেটে হাসি এল তুর্যের...তার উপর আবার কি অদ্ভুদ সম্ভাষণ...
''তুর্য ,এই তুর্য...১০ সেকেন্ডে না উঠলে কিন্তু গায়ে পানি ঢেলে দিব আমি।'' চোখ মিটমিট করলো তুর্য। সামনে একটা হাসি হাসি মুখ দেখা যাচ্ছে। প্রথমে বুঝতে পারলনা কোথায় আছে...ভালো মতো তাকাতেই বুঝতে পারল সামনের হাসি হাসি মুখ টা কার। তারমানে স্বপ্ন দেখছিল? যাক বাবা বেচে গেলাম ভেবে আবার চোখ বুজে ফেলল তুর্য। আবার ওর কাঁধ ঝাঁকাল নিঝুম 'প্লীজ,আমি এখন ঘুমাব...কালকে অফিস আছে''তুর্য মিনমিন করে বলতে চেষ্টা করলো ''আধ ঘণ্টার জন্য ঘুম ভাংলে কিচ্ছু হয়না...দেখি এখন উঠ...নাহলে কিন্তু আমি পানি আনতে গেলাম'' এবার বিনা বাক্যব্যয়ে তুর্য উঠে বসলো। নিঝুমের পক্ষে সব সম্ভব। আরেকবার রাত দুপুরে এরকম না ওঠায় নিঝুম ওর গায়ে পানি ঢেলে দিয়েছিলো। ব্যাপারটা মনে করেই ঠাণ্ডায় ওর গা কেপে উঠল। ''মুখটা একটু ধুয়ে আসো...নাহয় আবার ঘুমায় যাবা।'' বাধ্য ছেলের মতো তুর্য বাথরুমে গেলো। বের হয়ে দেখে যে টেবিলের উপর একটা ট্রেতে দুটো মগ রাখা।এরপর তাকাল দেয়াল ঘড়ির দিকে। রাত দুইটা বাজে।দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল আপনা আপনি। রাত দুপুরে কেন যে নিঝুম এমন পাগলামি করে! বারান্দাতে টুকটাক আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আজকে কি জোছনা নাকি? নিঝুমের আওয়াজ শোনা গেলো
''তুমি বের হয়েছ? একটু কষ্ট করে ট্রেটা নিয়ে এসোনা প্লীজ...''
''আনছি''
বারান্দায় ঢুকে দেখল এক কোনায় মাদুর বিছানো। তার উপর নিঝুম বসে আছে। চাদের আলো নিঝুমের মুখের উপর এসে পড়ছে। এতো স্নিগ্ধ দৃশ্য দেখে কারো মনে কি আর রাগ থাকতে পারে? এম্নিতেই তুর্য নিঝুমের উপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারেনা। এত মায়া মেয়েটার মাঝে! ও নিঝুমের পাশে গিয়ে বসলো।
''খুব রাগ করেছ আমার উপর?'' হাসি হাসি মুখে জানতে চাইল নিঝুম
''করেছিলাম,কিন্তু এখন আর রাগ নেই''
''হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো আমার। তখন বাইরে দেখি কি সুন্দর আকাশ। একা একা দেখতে ভালো লাগবেনা। তাই তোমাকে ডাকলাম '''
হাসল তুর্য ''ভালো করেছ''
হাত বাড়িয়ে কফির মগ টা নিঝুমের হাতে দিল। ওর আসলেই ভালো লাগছে পরিবেশটা। কেমন যেন অন্য জগতের বাসিন্দা মনে হচ্ছে নিজেদের। নিঝুম শক্ত করে তুর্যের হাত ধরে রেখেছে। যেন ছেড়ে দিলে আর তুর্যকে খুজে পাবেনা। আহ! তুর্যের মনে হচ্ছে এই সময়টাকে যদি এখানে আটকে রাখা যেত!! অফিসে বসে ফাইল চেক করছিল তুর্য। লাঞ্চ টাইম হয়ে এসেছে। এই ফাইলটা শেষ করেই খেতে যাবে। এমন সময় মেসেজ এল। নিঝুমের লেখা। দেখেই তুর্যের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুতে উঠল। মেসেজে লিখা
''একা ঘরে বসে আমি ভাবছি শুধু তোমায় তুমি আমার ঘরের বাতি আঁধারও তাই পালায়''
সাথে সাথে আরেকটা মেসেজ ''জলদি খেয়ে নাও'' লেখা।
প্রায় নিঝুম এই কাজ করে। ছোট ছোট ছড়া লিখে পাঠায়। রাগ করলেও ছড়াই লিখে। অনেক যত্ন করে তুর্য ওর মোবাইলে মেসেজ গুলো রেখে দিয়েছে। তুর্য রিপ্লাই দিল
''তোমাকে অনেক ভালবাসি''
এরপর আরেকটা দিল ''খেতে যাচ্ছি,তুমিও খেয়ে নাও''
এসব ছেলেমানুষি করার কথা তুর্য আগে কখনও ভাবতেও পারেনি। কিন্তু এখন এই কাজগুলো করে ও অনেক আনন্দ পায়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল নিঝুম কখনও একটা গিফট পেয়ে এত খুশী হয়না যতটা না একটা মেসেজ বা একটা গোলাপ পেয়ে হয়। নিঝুমের মতো একটা মেয়ে তার মতো ছেলের ভাগ্যে কিভাবে জুটল এটা ভাবতেই তুর্যের অবাক লাগে। যেদিন নিঝুম কে প্রথম দেখতে গিয়েছিল সেদিনের কথা মনে পড়লে এত ভালো লাগে ওর! একান্তে কথা বলার জন্য যখন ওদের কে সুযোগ দেয়া হয় তখন নিঝুমের প্রথম প্রশ্ন ছিল
''আপনি কি চোখে কম দেখেন?'' তুর্য অবাক হয়ে বলেছিল ''
কেন? আমার চোখ তো ঠিক আছে।''
''ঠিক থাকলে আমাকে কেন পছন্দ করলেন?''
''এটা কোন ধরনের প্রশ্ন?'
''আমি তো দেখতে ভালো না। বেশির ভাগ ছেলেই আমার ছবি দেখেই না করে দেয়''
''আমার তো মনে হয় ওই ছেলেগুলোরই চোখ খারাপ''
ফিক করে হেসে দিলো নিঝুম। হাসলে ওর গালে টোল পড়ে। এই হাসি দেখেই নিঝুমের প্রেমে পড়ে গেলো তুর্য।
''প্রহর শেষে আলোয় রাঙ্গা সেদিন চৈত্র মাস তোমার টোলে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ''
বাসায় এসে সবাইকে জানিয়ে দিল তুর্য,এই মেয়েকেই বিয়ে করবে সে। চারটা বাজে। এখনি তুর্য অফিস থেকে বের হবে। নিঝুম বারবার কল দিচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে বেরোতে গিয়ে অফিসের দরজায় একটা বাড়িও খেল তুর্য। নিচে নেমে গাড়ির স্টার্ট করতে যাবে তখনি আবার কল আসলো। নিঝুম।
''হ্যাঁ আমি আসছি,১০ মিনিট ওয়েট করো।''
''গাড়ি থেকে নেমে বাইরে এসো।''
''কেন?''
''আমি বাইরে রিকশা নিয়ে এসেছি,আজকে রিকশায় ঘুরবো''
''এখন?''
''জী এখন''
তুর্য নেমে আসলো। বাইরে সত্যি নিঝুম রিকশাতে বসে আছে। মুখে সেই চির চেনা টোল পড়া হাসি। রিকশাতে উঠে বসলো তুর্য। ওর কি রাগ করা উচিত বুঝতে পারছেনা। এই মুহূর্তে কি নিঝুম এসব না করলে হয়না? নিঝুম মনে হয় তুর্যের চেহারা দেখে আন্দাজ করতে পেরেছে।
''খুব জ্বালাই তোমাকে,না?''
কিছু বলল না তুর্য। ও ঠিক করলো আজ নিঝুমের কোনও কথার জবাব দিবেনা।
''এই শোন,রাগ করেছো ভালো কথা। কপাল কুঁচকাও কেন? মনে হচ্ছে ৬০ বছরের বুড়ো লোকের পাশে বসে আছি।আমি যতদূর জানি তোমার এত বয়স হয়নাই। নাকি বিয়ের সময়ে মিথ্যা বলেছিলে?''
তুর্য মুখ শক্ত করে অন্য দিকে আছে, এই মুহূর্তে ওর একটাই চিন্তা কিভাবে ওর পাশে বসা ফাজিল মেয়েটার কথা না শোনা যায়। কারন অলরেডি ওর হাসি পাচ্ছে। আচ্ছা মুশকিল হল দেখি।
''দেখি তো,তোমার দাঁত দেখি... আসলই তো মনে হয়...এই তোমার চুল গুলা কি নকল?'' বলে তুর্যের চুল ধরে হাল্কা টান দিল নিঝুম। তুর্য কটমট করে তাকাতেই বলল
''নাহ, একদম আসল দেখি। আমার তো মনে হচ্ছিল তুমি কিছু করেছো। ওই যে একটা চুলের বিজ্ঞ্যাপন আছেনা? ''টাক সমস্যার তাক লাগানো সমাধান'' ওইটার মতো''
তুর্য আর পারলনা... হোহো করে হেসে উঠল। নিঝুমের সাথে রাগ করে থাকা একদমই অসম্ভব।
''তুমি আসলেই একটা চীজ'' নিঝুম ও তুর্যের সাথে সাথে হাসছে। এত সুন্দর হাসি মেয়েটার! বিয়ের পর এত দিন হয়ে গেলো তারপর ও তুর্য নিঝুমের হাসি যতবার শুনে মনে হয় প্রথমবারের মতো শুনছে। এটা কি শুধু ওর সাথেই হয়?
''কি দেখছ এভাবে?''
''তোমার হাসি''
নিঝুম একটু লজ্জা পেয়ে যায়।
''আমি চাই আমার মেয়ে তোমার মতই হাসবে,টোল পড়া হাসি''
''ছেলেও তো হতে পারে''
''তা পারে। কিন্তু আমি চাই আমার লাইফে আরেকটা ছোট্ট নিঝুম আসুক''
নিঝুম কিছু না বলে তুর্যের হাত ধরল। ওর এই কাজটার মানে তুর্য এখন বুঝে। খুব আবেগপ্রবন হয়ে গেলে নিঝুম কথা বলতে পারে না।শুধু তুর্যের হাত ধরে রাখে। এই একটা সময়ে ''নিঝুম'' নামের সাথে নিঝুমের সাথে মিল পাওয়া যায়। তুর্য বুঝতে পারে নিঝুম ওকে প্রচণ্ড ভালবাসে। ঠিক যেমন ও নিঝুম কে। ''একটু সমস্যা হয়েছে,আপনি কিছুক্ষন অপেক্ষা করুন, ডাক্তার আসছেন।'' এ কথা বলেই নার্স দ্রুত চলে গেলো। তুর্য বুঝতে পারলনা প্রথমে। কি ধরনের প্রবলেম? নিঝুমের ডেলিভারি তে কোনও জটিলতা আসার কথা না। ওরা ডেইলি চেক আপ করেছে। তখন তো বাচ্চার কন্ডিশন ভালই ছিল। অস্থিরভাবে পায়চারি করছে তুর্য। অনেক বেশি টেনশন হচ্ছে। ওরা দুজন ঠিক আছে তো? দু রাকআত নফল নামাজ পড়ে আসবে কি? খুব কান্না পাচ্ছে তুর্যর। কেন জানে না।
''এই তুর্য,চেহারা এমন করে রেখেছিস কেন?'' শাওন পাশে এসে দাঁড়াল। তুর্যের খুব কাছের বন্ধু শাওন।
''দোস্ত,নিঝুমের কিছু হবে নাতো? ওর কিছু হলে আমি বাচবোনা''
''আজব তো,তোকে একথা কে বলেছে? ভাবি ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না...আরে বাবা কাঁদছিস কেন মেয়েদের মতো?''
তুর্য কোনও কথা বলল না। ওর শুধু ইচ্ছে হচ্ছে নিঝুমের পাশে ওর হাত ধরে বসে থাকতে। নিঝুম কে বলতে যে তুর্য ওকে কতটা ভালবাসে।
''আল্লাহ পাক,আমার নিঝুমকে ঠিক করে দাও। আমি আর কিছু চাইনা। শুধু নিঝুমের যাতে কোনও ক্ষতি না হয়''
মনে মনে তুর্য দোআ পরেই যাচ্ছে। ডাক্তার কে বের হতে দেখে তুর্য জলদি হেঁটে গেলো সামনে। ভয়ে আর দুশ্চিন্তায় তুর্য কিছু বলতে পারলনা। চেহারা দেখে বোধহয় ডাক্তার বুঝে নিলেন তুর্যের অস্থিরতা...তুর্যের হাত ধরে বললেন ''dont worry youngman,তোমার ওয়াইফ একদম ঠিক আছে। একটু দুর্বলতা ছিল প্রথমে। but she pulled up...আর তোমার পুত্র সন্তান হয়েছে। he is in perfect and healthy condition....congratulations'' তুর্য কোনও কথা বলল না। ওর চোখ দিয়ে অবিরাম অশ্রু ঝরছে। তবে কিছুক্ষণ আগে যা ছিল অনিশ্চয়তার,এখন তা হল আনন্দের। তোয়ালের মধ্যে পেঁচিয়ে একটা ছোট পুতুল কে তুর্যের কোলে দেয়া হয়েছে। এত নরম শরীর যে তুর্যের ভয় লাগছে কোলে নিতে। সে অনেক সাবধানে কোলে নিয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকাল। আর অভিভূত হয়ে গেলো।এটা ওর ছেলে! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। ওর নিজের অংশ!!! ও একবার ছেলের দিকে আর একবার নিঝুমের দিকে তাকাচ্ছে। নিঝুম বেডে শুয়ে আছে। চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। ওর এখন বিস্রাম দরকার। কিন্তু বাবা আর ছেলের প্রথম দেখা হওয়ার মুহূর্তটা যাতে মিস না করে তাই সে অনেক কষ্টে জেগে আছে।
''কি? নিজেকে বাবা বাবা লাগছে?''
তুর্য লাজুক হাসি দিল।''ও দেখতে একদম তোমার মতো হয়েছে।''
''উঁহু,তোমার মতো''
''আমি ওকে কি ডাকব জানো? সূর্য'...তুর্য পুত্র সূর্য''
তুর্যের মনে হয় নামটা বেশ পছন্দ হল। বেশ কয়েকবার আপন মনে সূর্য বলল সে। এরপর এক হাতে সূর্য কে রেখে খুব সাবধানে অন্য হাত নিঝুমের মাথায় রাখল।
''এখন ঘুমাওতো সূর্যের আম্মু,আমি পাশেই আছি''
''জানি'' মিষ্টি হাসি দিল নিঝুম। এত ধকলের পরও নিঝুমের হাসি অমলিন রয়ে গেছে। তুর্যের হাত টা নিজের হাতে নিল সে। শক্ত করে ধরে নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলল। পরম নির্ভরতার সাথে ঘুমের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে যেতে নিঝুম অনুভব করলো যে ও একা নয়। দুজন মানুষঅধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ওর জন্য। প্রত্যেক বৃহস্পতিবার বিকেলে তুর্যকে জলদি বাসায় ফিরতে হয়। নিঝুমের কড়া আদেশ। এর হেরফের হতে পারবেনা।এদিন ওদের রিকশা ভ্রমনের দিন।তুর্য অনেক নিষ্ঠার সাথে নিজের দায়িত্ত পালন করে। রিকশায় ছেলের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে প্রায় ওর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। নিঝুম অনেক মজা পায় এসব দেখে আর সূর্যকে বলে'' দেখলে আব্বু,তোমার বাবা কিচ্ছু জানে না'' সূর্য তখন প্রবল বেগে মাথা নাড়ে। ওর বাবা সব জানে। আর তুর্য বলে ''ছেলে আমার সবই জানে, তাইতো শুধু বাবার কথাই মানে'' মা আর ছেলের হাসি তখন দেখে কে। সূর্য হাসলে বাঁ গালে একটা টোল পড়ে,ঠিক নিঝুমের মতো।
SHARE

0 comments: